আজ ৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

খুলনায় চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য গড়েছিলেন পুলিশ কমিশনার

মাসুম বিল্লাহ ইমরান, বিশেষ প্রতিনিধি খুলনা : খুলনার বুকে মোজ্জামেল হক ছিলেন যেন এক অদৃশ্য সম্রাট, যার অধীনে গড়ে উঠেছিল চাঁদাবাজির এক অভিজাত সাম্রাজ্য। শহরের প্রতিটি কোণ- আবাসিক হোটেল, বাসস্ট্যান্ড, স্বর্ণ পাচার, জুয়ার আসর, ক্লাব, এমনকি পরিবহন ব্যবস্থাতেও ছিল তার নেটওয়ার্কের শক্তিশালী হাত।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএম পি) শীর্ষ পদটিতে বসে টাকার নেশায় বুঁদ হয়ে কমিশনার মোজাম্মেল হক প্রতি মাসে চাঁদা আদায়ের টার্গেট বেঁধে দিতেন থানার ওসি-ডিসিদের। বিশ্বস্ত দুর্নীতিবাজ সহকর্মীদের খুলনায় এনে, ধীরে ধীরে এই সংগঠিত চাঁদাবাজির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি।

চাঁদাবাজির এই সাম্রাজ্য থেকে প্রতি মাসে খুলনার পুলিশ কমিশনারের কাছে জমা পড়ত বিপুল পরিমাণ অর্থ, যার অংশবিশেষ ভাগ-বাটোয়ারা হতো স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে।রাজনৈতিক সুযোগ বুঝে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা জামায়াত- সময়মতো সব দলের চাটুকারিতাও চালিয়ে গেছেন ওই দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা। ‘জয় বাংলা’ থেকে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’- সব স্লোগানই নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।

শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগের পর খুলনার পুলিশ কমিশনারের সেই ক্ষমতার দম্ভ ধূলিসাৎ হয়েছে। টাকার মোহে অন্ধ মোজ্জামেল হককে অবশেষে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তা মোজাম্মেল হকের বিদায়ের পর খুলনার সুশীল সমাজ মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা এখন দাবি জানাচ্ছেন, মোজ্জামেল হকের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হোক।

টার্গেট নির্ধারণ করে চাঁদা আদায় কেএমপির পরিদর্শক পদমর্যাদার চারজন কর্মকতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মাসে খুলনা সদর থানা থেকে পাঁচ লাখ টাকা আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করে দেন কমিশনার। এছাড়া অন্য সাতটি থানায় প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা করে মোট ২১ লাখ টাকা আদায়ের মাত্রা নির্ধারণ করে দেন তিনি।

মাসিক তিন লাখ টাকা জমা দিতে না পারায় ১০ মাস আগে এক থানার ওসিকে বিএনপির অনুসারী আখ্যা দিয়ে বদলি করে দেন কেএমপি কমিশনার মোজাম্মেল।

ওই ওসি বলেন, ‘আমাকে জমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে বলা হয়েছিল। তবে তিন লাখ টাকা বৈধভাবে আদায় করা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে এই পুলিশ কমিশনারের আন্ডারে আর চাকরি করা সম্ভব ছিল না।‘আমার ডেপুটি কমিশনার ভালো ছিলেন। তিনি আমাকে সেইভ করার চেষ্টা করেন। পরে কমিশনার আমাকে বদলি করে দিয়ে নতুন এক ওসিকে এনে সেই থানায় বসান।’

পরিদর্শকরা জানান, কমিশনারের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস ছিল পরিবহন খাত। নগর ট্রাফিক বিভাগকে প্রতি মাসে ১৫ লাখ টাকা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। এই টাকা আদায় করার জন্য শহরের ইজিবাইকগুলো থেকে মাসিক চাঁদা আদায় শুরু করেছিলেন সার্জেটরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সার্জেট বলেন, ‘খুলনা শহরে প্রচুর সংখ্যক ইজিবাইক রয়েছে। এই কমিশনার দায়িত্ব গ্রহণের পর ইজিবাইক থেকে মাসিক চাঁদা আদায়ের নির্দেশ দেন। কিভাবে আদায় করতে হবে, সেই দিকনির্দেশনাও দিয়ে দেন তিনি।

‘ইজিবাইকগুলো নিয়ম না মেনে কোথাও পার্কিং করলে এক হাজার ৫০০ থেকে দু’হাজার টাকা করে জরিমানা করতে বলেন। তবে যদি কোনো ইজিবাইক মাসিক তিন হাজার টাকা করে সার্জেন্টদের পরিশোধ করতো, তবে সেই মাসে অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য তাকে কোন মামলা দেয়া হতো না।’

তিনি বলেন, ‘মাসিক চাঁদা দেয়া ইজি বাইকগুলোকে কোনো টোকেন বা রং দিয়ে চিহ্নিত করা হতো না। বরং চালকদের নামের তালিকা করে সার্জেন্টরা এই হিসাব রাখতেন। মাসিক চাঁদার টাকা আদায় করা হতো বিকাশের মাধ্যমে।’

থানার ওসিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি কেএমপির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত থেকেও টাকার ভাগ নিতেন কমিশনার।

এর পাশাপাশি নগর ডিসি অফিসেও তার চাঁদা আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। কোনো গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে বিশেষ মূল্যবান কোনো কিছু জব্দ করতে পারলে ওই টাকার ভাগ নিতেন কমিশনার।এছাড়াও, পুলিশ লাইনের মেস থেকে মাসিক দুই লাখ, রেশন স্টোর থেকে এক লাখ ও কেএমপির গাড়িগুলোর জন্য প্রতি মাসে ইস্যুকৃত জ্বালানি তেল খাত থেকে তিন লাখ টাকা আদায় করতেন মোজাম্মেল হক। নগর পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে প্রতিটি পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য কমিশনারকে ২০০ টাকা করে দিতে হতো।

ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের এনে দল গঠন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাত্র কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার কাছে পুরো নগর পুলিশ জিম্মি ছিল। কেএমপিতে যোগদানের পর নিজের বিশ্বস্ত সব কর্মকর্তাকে বিভিন্ন স্থান থেকে তিনি খুলনায় বদলি করে নিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে রয়েছেন খালিশপুর থানার বর্তমান ওসি আনোয়ার হোসেন, যিনি পুলিশ কমিশনারের নিজ জেলা পাবনার সন্তান।

পরিদর্শকরা জানান, ওসি আনোয়ারের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন অপরাধে পর যেসব ওসি ও এসআইর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়, তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে মাফ পেয়ে যাওয়ার উপায় বের করে দেয়া।

এছাড়া থানার ওসিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন পুলিশ পরিদর্শক মো. হাফিজুর রহমান ও বিশেষ শাখার এএসআই মো. আব্দুর রাজ্জাক।

বর্তমানে কমিশনারের বাংলোর দায়িত্বে রয়েছেন এএসআই মো. আব্দুর রাজ্জাক। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টাকা আদায়ের বিষয় অস্বীকার করে বলেন, ‘এসবের সাথে আমি জড়িত ছিলাম না।’অন্যদিকে ওসি আনোয়ার বলেন, ‘আমি মোবাইলে এই বিষয়ে কোনো কথা বলবো না।’

কমিশনারকে বিএনপির ‘গণদুশমন’ আখ্যা ও ছাত্রদের বয়কট গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারে পতনের পর বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মিলে খুলনার যে পুলিশ সদস্যরা নানাভাবে প্রতারণা ও অবৈধ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, তাদের ‘গণদুশমন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ৭ আগস্ট একটি তালিকা প্রকাশ করে মহানগর বিএনপি। ওই তালিকায় নাম ছিল কেএমপি কমিশনার মোজাম্মেল হকের।

এ প্রসঙ্গে খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘কেএমপি কমিশনার ছাত্র-জনতার বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে সহায়তা করেছিলেন।’

এরপর ৮ আগস্ট কেএমপির সম্মেলন কক্ষে শিক্ষাথীদের তোপের মুখে পড়েন কমিশনার মোজ্জামেল হক।

সেখানে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আল মুজাহিদ আকাশ। তিনি পুলিশ কমিশনারের কাছে প্রশ্ন করেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে কেন আপনারা আমাদের ওপর গুলি চালালেন? ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর আপনারা কে? কার নির্দেশে আপনারা আমাদের ওপর গুলি চালালেন?’খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক তানভীর বলেন, ‘আপনার মতো পুলিশ কমিশনারকে আমরা খুলনাতে চাই না। আপনি আমাদের নিরীহ ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছেন।’

সেই সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের কর্মকাণ্ডের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চান কমিশনার মোজাম্মেল হক।

তিনি বলেন, ‘আমাদের কেন এগুলো করতে হয়েছিল তা এই সরকারের অধীনে চাকরিতে থাকলে তোমরা বুঝতে। এ নিয়ে আমি তোমাদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।’

‘জয়বাংলা’ থেকে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান।জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে ২০২৩ সালের ১৬ এক প্রজ্ঞাপনে মোজাম্মেল হককে কেএমপি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। খুলনায় যোগদান করেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। একইসঙ্গে খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেকর ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেন। কমিশনার যে কোনো সভায় যোগ দিয়ে তাদের পা ছুয়ে সালাম করতেন, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’ বেশ জোরেশোরেই উচ্চারণ করতেন।

খুলনা মহানগর বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিলটন বলেন, ‘এই পুলিশ কমিশনার খুলনায় যোগদানের পর বিএনপির কোনো নেতা রাতে নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারতেন না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে তিনি নিয়মিত বিএনপির নেতাদের ওপর নির্যাতন শুরু করেছিলেন। প্রতিনিয়ত গায়েবি মামলা ও গণগ্রেপ্তার করাটা যেন তার নেশা ছিল।’

তিনি বলেন, ‘কমিশনার মোজাম্মেল আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাদের পা ছুঁয়ে সালাম করতেন। পাশাপাশি চাঁদাবাজি করে নেয়া টাকার একটা অংশ তিনি ওই নেতাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন।’

তবে ৫ আগস্ট সরকার পতদের পর কমিশনার মোজ্জামেল হক মিশে যান বিএনপি নেতাদের সঙ্গে। তাদের নানা সভায় অংশ নিয়ে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেয়া শুরু করেন। পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রশংসা শুরু করেন।

কমিশনার মোজাম্মেল হক ৮ আগস্ট ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে কেএমপিতে দাওয়াত দেন বিএনপি নেতাদের। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা। সে সময় কমিশনারকে সংশোধন হতে হুঁশিয়ারি দিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক তানভীর বলেন, ‘আপনারা এতদিন একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছেন৷ এখন আরেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে আমাদের সভা করার জন্য ডেকেছেন।

‘আপনাদের চাটুকারিতা কমে নাই। আমরা আপনাদের মতো চাটুকার পুলিশ কর্মকর্তাদের চাই না। আপনারা নিজ বিভাগের মধ্যে সংস্কার করেন। চাটুকারিতা বাদ দেন।’

তদন্তের দাবি সুশীল সমাজের খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মোজাম্মেল হককে ২৭ আগস্ট সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ওই রাতেই তিনি খুলনা ছেড়ে চলে যান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

তবে তার অন্যায় কর্মকাণ্ডের জন্য শুধু বাধ্যতামূলক অবসর নয়, তদন্ত করে শাস্তি নিশ্চিতের দাবি সুশীল সমাজের।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) খুলনা শাখার সভাপতি কুদরত-ই খুদা বলেন, ‘পুলিশের যে পর্যায়ের কর্মকর্তা হোক না কেন, তাকে শুধু অবসরে পাঠালে হবে না। অন্যায়ের জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

‘রাষ্ট্রে শাসন ফিরে এসেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের রাষ্ট্র থেকে জনগণের রাষ্ট্র হয়েছে। এতদিন যারা অন্যায় করেছে, তদন্ত করে তাদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ