আজ ১লা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৫ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বিজিবি’কে ম্যানেজ করে জব্দকৃত বালু পাথর লুট, দূর্ঘটনার শিকার শিক্ষার্থীরা

মো আব্দুল শহীদ, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পশ্চিম ডলুরা এলাকায় প্রায় শতাদিক ট্রাক্টর দিয়ে নারায়ণতলা ও ডলুরা বিজিবি ক্যাম্প ম্যানেজ করে ইজারাবিহীন ধোপাজান-চলতি নদী থেকে কোটি কোটি টাকার অবৈধ বালু-পাথর উত্তোলন করছে দেলোয়ার সিন্ডিকেট চক্র। উত্তোলিত বালু পাথর সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাক্টর, ট্রলি ও পিকআপ দিয়ে ডলুরা সীমান্তের বিভিন্ন ফাকাঁ জায়গা, বসতবাড়ির আঙ্গিনাসহ হালুয়ারঘাট রহমতপুর সুরমা নদীর তীরে এবং মইনপুর ক্র্যাশার মিলে ডাম্পিং করা হচ্ছে।

এদিকে মইনপুর গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ি সুজন মিয়া এসব বন্ধে উপজেলা নিবাহী অফিসার ও জেলা প্রশাসক বরাবরে একাদিক অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ দায়ের করার পর সহকারী কমিশনার ভূমি মইনপুর ক্র্যাশার মিলে অভিযান পরিচালনা করে মালামাল সহ একটি নৌকা জব্দ করেছে। কিন্তু থেমে নেই ক্র্যাশার মিলে অবৈধ বালু পাথর ডাম্পিং। ট্রাক্টর দিয়ে দিন রাত বেপরোয়া পরিবহন করায় মঙ্গলকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সড়ক দূর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান।

এই সড়ক দূর্ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে কামারগাঁও এলাকায় আরেক শিশু শিক্ষার্থী মালবাহী ট্রাকের ধাক্কায় গুরুত্বর আহত হয়ে বর্তমানে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। বালু পাথর খেকো সিন্ডিকেট চক্র প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের এই অবৈধ কাজে কেউ প্রতিবাদ করলে বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করারও অভিযোগ উঠেছে।

ডলুরা থেকে প্রায় ৪টি বাজার ৪টি পয়েন্ট,নারায়ণতলা উচ্চ বিদ্যালয়,ইয়াকুবিয়া দাখিল মাদ্রাসা,মঙ্গলকাটা উচ্চ বিদ্যালয়,হুসনা একাডেমী সহ বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাড়ি দিয়ে সুরমা নদী তীরবর্তী মইনপুরে বালু-পাথর ডাম্পিং করছে। এতে প্রতিনিয়ত দূর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারী ও শিক্ষার্থীরা। রাতের আধারে দেলোয়ার হোসেনের ক্র্যাশার মিল হতে লোডকৃত মালামাল ঢাকা-ভৈরব সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে বালু পাথর বিক্রি করা হচ্ছে ।

খনিজ সম্পদ রক্ষার্থে প্রশাসনের নিদের্শে নৌ পথ বন্ধ করার পর দেলোয়ার হোসেন গং পথ বদলে সড়ক পথে অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রমিকরা বলেন, দেলোয়ার হোসেন সিন্ডিকেট চক্রের কারণেই ধোপাজান চলতি নদী সরকার ইজারা দিচ্ছেন না। নদীতে রাতের বেলায় ড্রেজার মেশিন এবং দিনের বেলায় শতাদিক ট্রাক্টর দিয়ে অবাদে বালু উত্তোলন করছে। আমরা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চালন দিয়ে বালু চানিয়ে এবং কুড়িয়ে কুড়িয়ে কিছু পাথর জমানোর পর সিন্ডিকেটের কারণে অন্য কারো কাছে বিক্রি করতে পারছি না। আমাদেরকে জিম্মি করে মাত্র ৩৫ টাকা ফুটে তাদের কাছে পাথর বিক্রি করতে হয়। সারাদিন কাজ করে ৪ থেকে সাড়ে ৪শত টাকা উর্পাজন করি তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চালাই। দেলোয়ার হোসেনের স্তুপকৃত প্রায় ২ কোটি টাকার অবৈধ পাথর গত ২-৩ দিন আগে প্রশাসন জব্দ করেছে। সেগুলো দায়িত্বরত বিজিবি’র জিম্মায় রাখা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল রহস্যজনক ভাবে রক্ষকই বক্ষকে পরিণত হয়ে গেছে। রাত পোহালেই দৃশ্যমান দেখা যাচ্ছে যে জব্দকৃত পাথর কমতে শুরু করেছে। বিজিবিকে ম্যানেজ করে জব্দকৃত পাথর ট্রাক্টর দিয়ে প্রতিরাতেই নিয়ে যাচ্ছে মইনপুরে। এই মুহুর্তে সরকার যদি পাথর নিলাম না করে তাহলে আর কিছুদিন গেলে অর্ধেকে পরিণত হবে। সিন্ডিকেট চক্র আমাদের কাছ থেকে পাথর ক্রয় করে অন্যত্র সরিয়ে না নেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রশাসন পাথর জব্দ করে নিলাম করলে সিন্ডিকেট চক্র নিলামে অংশ নিয়ে পাথর ক্রয় করেই নদীতে ড্রেজার লাগিয়ে লক্ষ লক্ষ ঘনফুট পাথর উত্তোলন করে বৈধ দেখিয়ে চোরাই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

জানা যায়, সদর উপজেলার সুরমা ও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন সড়কে ফিটনেছবিহীন ট্রাক্টর, ট্রলি, পিকআপ, নসিমন, করিমন গাড়ি চলাচল করে আসছে। নৌ পথ বন্ধ হওয়ার পর থেকেই গত দুই মাস ধরে দিনে ও রাতে বেপরোয়া চলাচল করছে এই অবৈধ যানবাহন। এতে হালুয়ারঘাট-মঙ্গলকাটা, মঙ্গলকাটা-চৌমুহনী, চৌমুহনী-ডলুরা, মীরেরচর-কৃষ্ণনগর, কৃষ্ণনগর-বেরীগাঁও সড়কের, আমপারা-সৈয়দপুর, সৈয়দপুর-ইব্রাহীমপুর সড়কের এবং ইব্রাহীমপুর-মইনপুর সড়কের মারাত্মক বিনাস হয়েছে। এসব বেপরোয়া ও অবৈধ বালু-পাথরবাহী যানবাহন চলাচলের বিকট শব্দে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন-যাপন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেছে। সড়ক পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা দিনের বেলায় সড়কে চলাচলে নিরাপত্তা নেই, সড়কের পাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর লেখাপড়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি, রাতের বেলায় নির্বিঘ্নে ঘুমানো যাচ্ছে না। যানবাহন চলাচলের বিকট শব্দে রোগীদের মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়ে আসছে।

স্থানীয় একাধিক বাসিন্দারা জানান, আমাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে খুবই সুচিন্তায় থাকি প্রতিদিনেই ছোট কাট দূর্ঘটনার শিকার হচ্ছে পথচারী সহ শিক্ষার্থীরা। গত ১০ বছরে অন্তত শতকোটি টাকার রাস্তা-ঘাটের বিনাস হয়েছে। এই কারণে দুই ইউনিয়নের কয়েকটি রাস্তা সদ্য মেরামতের পরপরই নষ্ট হয়েছে। এই অবৈধ মালবাহী যানবাহন চলাচলের কারণে মুর্চা থেকে আমপাড়া বাজার পর্যন্ত রাস্তার বেহাল অবস্থা এখনও দৃশ্যমান রয়েছে। চলতি নদী সংলগ্ন ডলুরা এলাকার বালু পাথর সিন্ডিকেট প্রধান দেলোয়ার হোসেন, সাদেক মিয়া গংরা আমপাড়া বাজার থেকে সৈয়দপুর হয়ে ইব্রাহীমপুর গ্রামের আনন্দ বাজার পর্যন্ত রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি চরমে। পূর্ব ইব্রাহীমপুর থেকে উত্তরপাড়া পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। মইনপুর কবরস্থানের পাশের রাস্তা প্রায় দুইশত ফুট ইট সলিং রাস্তার বেহাল অবস্থা হয়েছে। মালবাহী পিকআপ ও ট্রলি চলাচলের কারণে হালুয়ারঘাট-রহমতপুর কাঁচা রাস্তার বেহাল অবস্থা হয়েছে। এসব সড়কে মালবাহী ট্রলি-পিকআপ চলাচল নিষিদ্ধ করার দাবি স্থানীয়দের।

মঙ্গলকাটা বাজারের ব্যবসায়ি হাদীউজ্জামান হাদী বলেন, বালু-পাথরবাহী ট্রলি-পিকআপ বেপরোয়া চলাচলের কারণে আমাদের চলাচলে নিরাপত্তা নেই, শিক্ষার্থীর লেখাপড়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা এসব অবৈধ যানবাহন বন্ধের দাবি জানাই। পাশাপাশি চোরাকারবারী দেলোয়ার হোসেন গংদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিরও জোর দাবি জানাই।

চৌমুহনী এলাকার বাসিন্দা শাহ আলম ইলিয়াস বলেন, যানবাহন চলাচলে সড়কের বিনাশ, লেখাপড়ার এবং রোগীদের সমস্যা হচ্ছে। আমরা চাই এসব অবৈধ যানবাহন দ্রুত বন্ধ করে সড়ক নিরাপদ করা হোক। বালু ও পাথর খেকোদের আইনের আওতায় আনা হোক।

জাহাঙ্গীরনগর ইউপি চেয়ারম্যান রশিদ আহমদ বলেন, অবৈধ মালামাল বন্ধে অনেকেই জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু এসব বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাই।

বালু পাথর সিন্ডিকেট প্রধান দেলোয়ার হোসেন জানান, ভাই আমি নিজেও জানি ইজারাবিহীন ধোপাজান নদী থেকে বালু পাথর উত্তোলন অবৈধ। কিন্তু কি করব শত শত শ্রমিক বেকার। তাই অবৈধ জেনেও তাদেরকে কাজে লাগিয়েছি। এরা সবাই আমার নিকট আত্নীয় স্বজন। আপনারা আমাদেরকে একটু সহযোগিতা কইরেন।

সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি ইসমাইল রহমান বলেন, গত কয়েকদিন আগে মইনপুর ক্র্যাশার মিলে অবৈধ বালু পাথর ডাম্পিং করায় আমরা অভিযান পরিচালনা করে একটি নৌকা ও ক্র্যাশার মিলের অনেক যন্ত্রাংশ জব্দ করেছি। যদি ধোপাজান চলতি নদী থেকে অবৈধ বালু পাথর উত্তোলন করে ডাম্পিং করে তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়নের কাইয়ার গাও সহ সীমান্ত এলাকার অনেক গ্রামের পাশের নদীতে গভীর রাতে পরিবেশ বিধ্বংসী ড্রেজার ও সেইভ মেশিন দিয়ে বালু-পাথর উত্তোলন করছে অবৈধ ভাবে। ফলে ড্রেজার তান্ডবে বারকী নৌকা দিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই।

বারকী শ্রমিক সংঘের সভাপতি নাছির উদ্দিন, ও শ্রমিক নেতা সাইফুল আলম ছদরুল জানান  বৈধ ভাবে সনাতন পদ্ধতিতে অর্থাৎ বেলচা,বালতি দিয়ে বালু-পাথর উত্তোলন করলে পরিবেশের কোন ক্ষতি হয়না এবং সাধারণ মানুষ কাজ কারবার করে সংসার চালান। সরকার যদি ক্রয় পদ্ধতির মাধ্যমে ধোপাজান নদীর বালু-পাথর উত্তোলন করতো তাহলে ভাল হত।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইউএনও অতীশ দর্শী চাকমাও ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দিয়েছেন।

পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান বলেন, আমি ডিসি মহোদয়ের সাথে কথা বলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সুনামগঞ্জ ২৮ বিজিবির অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল এ কে এম জাকারিয়া কাদির জানান বিষয়টি আমি দেখব।

জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া জানান, তিনি বিজিবির অধিনায়ক পুলিশ সুপার সহ অন্যান্য বাহিনীর সাথে কথা বলে শীঘ্রই ব্যবস্থা নেবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ