আজ ১৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বুড়িচং খোলা আকাশের নিচে বন্যাদুর্গত দেড় লক্ষাধিক মানুষ 

প্রধান প্রতিবেদক :  বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়ায় গোমতীর বাঁধ ভাঙায় বন্যাকবলিত দেড় লক্ষাধিক মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। ভাঙা অংশ দিয়ে এখনো পানি ঢুকছে লোকালয়ে।

বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার হওয়া লোকজন সব হারিয়ে হাহাকার করছেন। এখনো পানিবন্দী আছেন অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। আজ শুক্রবার বিকেলে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বুড়িচং উপজেলার অন্তত ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

বুড়িচং উপজেলার সঙ্গে আদর্শ সদর উপজেলার একাংশ, ব্রাহ্মণপাড়া ও দেবীদ্বার উপজেলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুড়িচং উপজেলার ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়নি।

বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সকাল ১০টায় তৈরি করা শীটে উল্লেখ করা হয়, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৬০ হাজার পরিবার বন্যা আক্রান্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার। ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেনাবাহিনী কয়েকটি গ্রামে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে।

সরেজমিনে বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়ায় গোমতীর বাঁধভাঙা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকা–সংলগ্ন বাঁধে গতকাল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নারী, পুরুষ ও শিশুরা অবস্থান নিয়েছেন। অনেকে তাঁদের গবাদিপশু নিয়ে এসেছেন। কেউ ভবনের ছাদে রেখে এসেছেন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুকনা খাবার বিতরণ করলেও বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের সংকট রয়েছে।

রাজাপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, তাঁর মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে তাঁদের ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। চোখের পানি ফেলে শাহজাহান জানান, তাঁর এই টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া।

ভরাসার গ্রামের হোসেন মিয়া বলেন, তাঁর পুকুরের সব মাছ ভেসে গেছে। চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখেছেন।

বুড়িচং উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সেনাসদস্যদের উদ্ধার তৎপরতা দেখা গেছে। গাজীপুর এলাকার গৃহবধূ আকলিমা আক্তার বলেন, তাঁর বাড়িতে ঘরের চালা পর্যন্ত পানি। গতকাল রাতে ভাত খেয়েছেন। আজ বিকেল পর্যন্ত আর ভাত খাননি। শুকনা বিস্কুট আর পানি খেয়েছেন। কোলে সাত মাসের বাচ্চাকে নিয়ে আকলিমা কান্না করছিলেন। তাঁর স্বামী ঢাকায় থাকে। বন্যার কথা শুনে বাড়িতে আসছেন। তাঁদের ফোনে চার্জ নেই। নেটওয়ার্ক নেই। যোগাযোগ করতে পারছেন না স্বামীর সঙ্গে।

খাড়াতাইয়া এলাকার সুমন মিয়া বলেন, তিনি তাঁর স্ত্রী সন্তান নিয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছেন। তাঁর মা–বাবার কবর ভেসে গেছে। মা–বাবার কবর দেখিয়ে সুমন বিলাপ করতে করতে বলেন, বাড়িঘর আর বাবা–মায়ের শেষ চিহ্নটুকু কেড়ে নিয়ে গেল গোমতী।

এদিকে আজ বিকেলে উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বাকশিমুল এলাকার দেখা যায়, লোকজন বাড়িঘর থেকে তাঁদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।

সত্তরোর্ধ্ব আবদুস সাত্তারের বাড়ি মহিষমারা এলাকায়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন সাত ঘণ্টা পর তাঁদের উদ্ধার করেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে উঁচু জায়গায় আসার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তাঁর জীবনে এত পানি দেখেননি। তিনি জীবনেও ভাবেনি এই পানি মাড়িয়ে এসে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে কেউ বাঁচাবেন।

কুমিল্লা শহরের শাসনগাছা থেকে বুড়িচং পর্যন্ত দুই দিকে গৃহপালিত পশু বেঁধে রেখেছেন বুড়িচংয়ের লোকজন। ব্যস্ততম এই সড়কের ইছাপুরার পর আর সামনে যাওয়া যাচ্ছে না। যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বুড়িচং উপজেলার বন্যায় আক্রান্ত সবার এখন খাবার, ওষুধ ও স্যালাইন প্রয়োজন। ত্রাণ কখন আসবে, সেদিকে তাকিয়ে আছের দুই লক্ষাধিক মানুষ।

কুমিল্লা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছৈয়দ আরিফুর রহমান জানান, কুমিল্লায় এখনো বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। রাতে বৃষ্টি হলে আরও অসহায় হয়ে পড়বেন ভানবাসি মানুষ।

কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল লতিফ জানান, আজ বিকেল পর্যন্ত গোমতীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী সাত–আট ঘণ্টা পর পানি স্বাভাবিক স্তরে ফিরতে পারে।

কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, ‘বুড়িচংসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আমরা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছি। উদ্ধার কার্যক্রমে উপজেলা প্রশাসন সমন্বয় করছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ