আজ ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আজ ৭ নভেম্বর।‘বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস

মোহাম্মদ শাহ্ আলম শফি 

আজ ৭ নভেম্বর। এই দিনটি কারো কাছে ‘সিপাহী বিপ্লব’ হিসেবে পালিত হয়। আবার কারো কাছে ‘বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে কিন্তু এই দিনটির আগমন কেন ঘটেছিল, তা আজ আর আলোচনায় আসে না। এই দিনটির উতপত্তি এবং যৌক্তক কারণ গুলো রাজনৈতিক ডামাডোলের মাঝে বিএনপি যেমন হারিয়ে ফেলেছে। তেমনি কর্নেল আবু তাহেরের উত্তরসূরীরাও দিনটির আসল উদ্দেশ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে ক্রেডিট দাবি করাতেই তৃপ্তি খুঁজছে। কিন্তু এই দিনটি কেন এসেছিল?

 

সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের আরো একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হল। এই জন্ম এমনি এমনি হয় নি। অনেক রক্ত এবং সম্ভ্রম এর বিনিময়ে সেই সাথে ভারতের সহযোগিতায় আমরা এই দেশটিকে পেয়েছি। বাংলাদেশ যখন যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায়, ঠিক তখনই ভারত তার সাহায্যের হাতটি গুটিয়ে নেয়। জুড়ে দেয় এক গাদা অপমানজনক শর্ত। তাজউদ্দিন আহমদরা সেই অপমানজন শর্ত সম্বেলিত ৭ দফার গোপন চুক্তিতে সই করেন। এই সই এর পরপরই ভারত বাংলাদেশের প্রকাশ্য মিত্রতা ঘোষনা করে সেই সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা তরুন যুবাদের প্রশিক্ষন প্রদান শুরু করে। সেই ৭ দফায় কি ছিল?

 

(১) বাংলাদেশে ভারত তার ইচ্ছামত, তার পছন্দসই লোক দিয় পছন্দসই নেতৃত্ব পাঠিয়ে একটি সামিরক বাহিনী গঠন করবে,যারা আন্তর্জতিক ভাবে আধা-সামারিক বলে পিরিচিত হবে,কিন্তু এদেরকে গুরুত্বের দিক থেকে ও সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের মুল সামরিক বাহিনী থেকে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ রাখা হবে। (ধারণা করা হচ্ছে,এই বাহিনীই হচ্ছে রক্ষীবাহিনী। ভারতীয় সৈন্যের পোষাক, ভারতীয় সেনানী মন্ডলীর নেতৃত্ব ও ভারতের অভিরুচি অনুযায়ী বিশেষ শ্রেণীর লোককে শতকরা ৮০ জন এবং ‘বিশেষ বাদ’-এর সমর্থক ২০ জন করে নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হচ্ছে। অস্র,গাড়ী,পোষাক,সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে এই বাহিনীটি মূল বাহিনীকে ছাড়িয়ে গেছে। এ বাহিনীটি ব্যাবহার করা হইবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে!! ভারত বিরোধী কোন সরকার ঢাকায় ক্ষমতায় বসলেও এ

বাহিনী দিয়ে তাকে উৎখাত করা হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত বিরোধী রাজনীতির সমর্থকদের এই বাহিনী দিয়েই দমন করা হবে। এই বাহিনীর মধ্যে ভারত প্রেমিক বিশেষ শ্রেণীর লোকের সংখ্যাগরিষ্ট হওয়ায় কোন দিন এদেরকে ভারেতর বিরুদ্ধে লাগানো যাবেনা। এদেশের জনগণ কোন দিন বিপ্লবে অবতীর্ণ হলে, রক্ষী বাহিনীর পোষাকে গুণে ভারতীয় সৈন্যরা লাখে লাখে রক্ষী বাহিনী সেজে এদেশের অভ্যন্তরে জনগণকে দমন করেত পারবে।)

 

(২)বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে যে সামরিক সাহায্য নিয়েছে তা পরিশোধ করতে হবে বিভিন্নভাবেঃ (ক)ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ অস্র কিনতে পারবে না। মাঝে মাঝে ঘোষণা করতে হবে ভারত থেকে এত কোটি টাকার অস্র কেনা হলো, এর দাম ভারতই ঠিক করে দেবে। সরবরাহ দেওয়া হবে অর্ধেক অস্র! সরবরাহকৃত অস্রও ভারত ইচ্ছামত নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবে। (অর্থাৎ,একই অস্র বারবার দেখিয়ে ১৯৭১ এর পাওনা এবং ভারতের সম্পূর্ণ যুদ্ধ খরচ আদায় করা হবে।অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দমনের জন্য অস্র ছাড়া কোন ভারী অস্র,সাজোয়া গাড়ী বা ট্যাংক বাংলাদেশকে দেয়া হবে না)

 

(৩) বাংলাদেশের বর্হিবানিজ্য ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ভারতের অনুমতি ছাড়া কোন পন্য বিদেশে রফতানী করা যাবেনা। কোন পন্য কত দরে বাইরে রফতানী করতে হবে ভারত সেই দর বেঁধে দেবে। এই সব পন্য ভারত কিনতে চাইলে বাংলাদেশ আর কারো সাথে সে পন্য বিক্রির কথা আলোচনা করতে পারবেনা। বাংলাদেশের আমদানী তালিকা ভারতের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।

(বাংলাদেশে বিদেশী পণ্য আমদানীর ব্যাপারে ভারত উদার থাকবে,যে সব পণ্য ভারতকে আমদানী করতে হয়-সেগুলি আমদানী করানো হবে বাংলাদেশকে দিয়ে। বাংলাদেশ তার বৈদিশিক মুদ্রার তহবিল ভেঙ্গে বিদেশ থেকে যে সব সামগ্রী আমদানী করবে সেগুলি ভারত নিজে আমদানী করবে না। চোরাচালানের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশ থেকে সেই মালগুলি ভারতীয় টাকায় যোগাড় করবে।)

 

(৪) বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পণ্ঞম বার্ষিক পরিকল্পনাগুলি ভারতকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। (বাংলাদেশ যেন স্বাবলম্বী হতে না পারে সেভাবে পরিকল্পনাগুলি কেটে ছিড়ে ঠিক করবে। যার ফলে বর্তমানেও দেখা যায় দেশের উৎপাদনশীল খাতের চেয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ বেশী দাতাদের এবং ঐসব খাতে ব্যায় করা হচ্ছে সরকারী অর্থ!)

(৫) বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অনুবর্তী রাখতে হবে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে ভারতের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে।

(৬) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার চুক্তিগুলি বাংলাদেশ একতরফাভাবে অস্বীকার করতে পারবে না! তবে ভারত এ চুক্তিগুলির কার্যকারিতা অস্বীকার না করলে বৎসর বৎসরান্তে এ চুক্তিমালা বলৎ থাকবে।

(৭) ডিসেম্বর যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তিটিতে বলা হয়েছিল যে, ভারতীয় সৈন্যরা যে কোন সংখ্যায়,যে কোন সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং বাঁধা প্রদানকারী কোন মহলকে নিশ্চিহ্ণ করে দিতে পারবে। ভারতীয় বাহিনীর এ ধরণের অভিযানের প্রতি বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি দিচ্ছে।ভারত চুক্তিটি নাকচ না করলে বৎসর বৎসরান্তে এ চুক্তি কার্যকারী থাকবে।

সংগ্রিহীতঃ বাংলাদেশঃ মারাত্বক অপপ্রচারণা, ষড়যন্ত্র ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের শিকার, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাজউদ্দিন সরকার সাহেব এর সরকার এই নীতিতেই দেশ চালাচ্ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন এবং সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পরপরই এই অপমানজনক চুক্তি মানতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি ইন্দিরা গান্ধিকে বলেন, তোমার সেনাবাহিনী আমার মাটি কখন ত্যাগ করতেছে? তাদেরকে দ্রুত তোমার নিজের দেশে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর।

মানুষ আশায় বুক বাঁধতে লাগল। এইবার বঙ্গবন্ধু তাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথ দেখাবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়োবালি। বঙ্গবন্ধু চললেন তার নিজের ইচ্ছামত। তিনি সেই ভারতের ইশারাতেই গড়ে তুললেন রক্ষি বাহিনী। জেনারেল অরোরা তার নিজের লেখা আত্নজীবনী মূলক বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন সেই ইতিহাসের কথা। সাধারণ মানুষ আবারো নিপীড়নের স্বীকার হলেন। সেই নিপীড়ন থেকেই গনবাহিনীর তৈরী হয়। বঙ্গবন্ধু এই গনবাহিনীও একদম নি:শ্বেস করে দেবার ব্যবস্থা করলেন। যাদের নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করলেন সেই তরুন যুবকদের নিয়ে গঠিত সমাজতান্ত্রিক দলের গনবাহিনীর ৩০ হাজার সদস্যকে হত্যা করলেন। তারপরও দেশে শান্তি ফিরল না। ১৯৭৪ এ নেমে এল দূর্ভিক্ষ। শুনতে খারাপ লাগলেও এই দূর্ভিক্ষের সময়ই বঙ্গবন্ধু তার পুত্রের বিবাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই বিয়েতে বঙ্গবন্ধুর ছেলে সোনার মুকুট পরে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ভ্রমনে গিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু সর্বশেষ ভুলটি করলেন নিজের হাতে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে গিয়ে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারীতে সংসদে আইন পাশ করে নিজেকে বাংলাদেশের আজীবন ক্ষমতার মালিক রেখে এক দলীয় আইন পাশ করলেন। এসব কিছুই চলতে লাগল ভারতের ইশারাতেই। ভারতের এই মোড়ল গিরি পছন্দ করল না সেনাবাহিনী। ভারতের মোড়ল গিরি থেকে চিরদিনের মত উদ্ধার পেতে ঘটানো হল ১৫ আগষ্টের হত্যাকান্ড। যদিও এই হত্যাকান্ডের আগে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ বঙ্গবন্ধুকে হুশিয়ার করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সাবধান হননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পরপরই ক্ষমতায় আসলেন খন্দকার মোশতাকের সরকার। এরপর আবারো ভারতের ইশারা এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাল্টা ঘটালেন ব্রি: খালেদ মোশাররফ। তিনি তৎকালীন সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে এই ক্যু ঘটান। ক্যু ঘটানোর পর তিনি নিজেই নিজেকে মেজর পদে পদউন্নতি প্রদান করেন। খালেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এদিকে মেজর জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দি করে রাখার দায়িত্ব দেয়া হয় এক তরুন অফিসারকে। তিনি জিয়ার বাড়ির থেকে যোগাযোগের সমস্ত ব্যবস্থা করলেন, মেজর জিয়ার বেডরুমের টেলিফোনের লাইন টি বিচ্ছিন্ন করতে ভুলে যান।

মেজর জিয়া টেলিফোন করলেন কর্নেল আবু তাহেরকে। কর্নেল তখন ছিলেন চট্টগ্রামে। মেজর জিয়া সংক্ষেপে শুধু বললেন, ‘সেভ মাই লাইফ’। এরপর কর্নেল সাহেব চট্টগ্রাম থেকে রওনা হলেন এবং অনুগত সেনাসদস্যদের এগিয়ে যেতে বললেন। এগিয়ে খালেদ মোশাররফ এর মা এবং ভাই ঢাকা শহরে মিছিল বের করলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে এই মিছিল বের করা হয়। আর এই মিছিলটি হল খালেদ মোশাররফের জীবনের জন্য কাল। মানুষ বুঝে ফেলল এই খালেদ মোশাররফ ভারতের এজেন্ট। সেও ভারতেরই সহায়তায় ক্ষমতা দখল করেছে। (পরে জানা যায়, খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ভারতের পররাষ্ট্র দফতরে মিষ্টি বিতরন করা হয়।)

কর্নেল সাহেব আর একটি অভ্যুত্থান ঘটালেন। সেই অভ্যুত্থান ঘটল সিপাহি জনতার হাত ধরে। মু্ক্ত হলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তখন বাংলার আকাশে বাতাসে একটি স্লোগানই মুখরিত হচ্ছিল, ‘সিপাহী জনতা ভাই ভাই’। এরপরই জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতায় বসানো হয়।

এতো লম্বা ইতিহাস বলার কারণটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। সেই সাথে অনুধাবনও করতে পারছেন। যে ভারতের বলয় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এতোসব ঘটনা ঘটল। সিপাহী বিপ্লবের জন্ম হল সেই ভারতের বলয় থেকে আমরা আজও বের হতে পারিনি। কথায় বলে, বাংলাদেশের টেবিলে নাকি ফাইল ট্রান্সফার হয় দিল্লীর হুকুমে। সেই দিল্লীর হুকুম গত৪ আগষ্ট পর্ন্তত শেখ হাসিনার সরকারের উপর খবরদারি করে যাচ্ছিল ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ