আজ ৮ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জামালপুরে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রকৌশলী ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে

রোমান আহমেদ, জামালপুর প্রতিনিধি : কিছুটা কাজ, কিছুটা অর্ধেক আবার কিছু অস্তিত্বহীন প্রকল্প দেখিয়ে করা হয়েছে প্রায় কোটি টাকা লুটপাট। এ ছাড়াও উপজেলা উন্নয়ন তহবিলের কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায়।

নিয়মনীতি না মেনেই প্রকল্প নিয়ে অর্থ লোপাটের আয়োজন করা হয়। অভিযোগ উপজেলা প্রকৌশলী ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।

উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায় , গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি ও উপজেলা উন্নয়ন তহবিল থেকে উপজেলার রাস্তাঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে প্রকল্প নেয়া হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ২৮ টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২৮ টি প্রকল্প এবং প্রকল্পের তদারকি ও আনুষ্ঠানিক ব্যয় সহ ৯৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরমধ্যে ১৩ টি প্রকল্পের ২৬ লাখ টাকার কাজ প্রকল্প কমিটির মাধ্যমে করা হয়। ১০ টি প্রকল্পের ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার কাজ দরপত্রের মাধ্যমে ও ৩ টি প্রকল্পের ১৫ লাখ টাকার কোটেশনের মাধ্যমে করা হয়।

উপজেলা উন্নয়ন তহবিল থেকে ১৫ টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৫ টি প্রকল্প ও প্রকল্পের তদারকি ও আনুষ্ঠানিক ব্যয় সহ ৮১ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই ১৫ প্রকল্পের মধ্যে ৪ টি প্রকল্পের ১৬ লাখ টাকার কাজ দরপত্রে করা হয়। ১১টি প্রকল্পের ৫৪ লাখ ১৯ টাকার কাজ কোটেশনের মাধ্যমে করা হয়।

বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ১৩ টি প্রকল্প কমিটির মাধ্যমে করা প্রকল্প গুলো উপজেলার-দুরমুট, কুলিয়া, নাংলা, নয়ানগর, চরবানীপাকুরিয়া,ঘোষেরপাড়া ও শ্যামপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলা সরঞ্জাম ও ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণে ৭ টি প্রকল্প নেয়া হয়। বাকী পাঁচটি প্রকল্পের মধ্যে মাহমুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের ল্যাটিন মেরামত,আদ্রা ইউনিয়নের মল্লিকা ডাঙ্গা এলাকার রাস্তা সংস্কার, ফুলকোচা ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ইটের বসার বেঞ্চ নির্মাণ, ঝাউগড়া ইউনিয়ন পরিষদের বাউন্ডারির ওপরের গ্রিল নির্মাণ, উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের দুস্থ ছাত্রছাত্রীদের মাঝে স্কুল ব্যাগ বিতরণ ও উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ। এই ১৩ টি প্রকল্পের প্রত্যেকটি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ ছিল ২ লাখ টাকা করে।

এডিপি’র প্রকল্প এলাকা সম্পর্কে জানা গেছে,’উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণের প্রকল্প নিলেও ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ করা হয়নি। মাহমুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের ল্যাটিন মেরামত ও আদ্রা ইউনিয়নের মল্লিকা ডাঙ্গা এলাকায় রাস্তা সংস্কারের কোন চিহ্ন নেই। ফুলকোচা ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বসার বেঞ্চ নির্মাণের কথা থাকলেও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামানের বাড়ির পাশে একটি মাত্র বেঞ্চ দেখা গিয়েছে। উপজেলা বিভিন্ন জায়গায় আরসিসি পাইপ সরবরাহে নামে সাড়ে তিন লাখ টাকার একটি প্রকল্প থাকলেও কোথাও সরবরাহ করা হয়নি। কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। দরপত্রের মাধ্যমে করা প্রকল্পের কিছু কিছু কাজ হয়েছে। তবে অধিকাংশ কাজেই নয়ছয় হয়েছে।

উপজেলা উন্নয়ন তহবিলের ১৫ টি প্রকল্পের খোঁজখবর নিয়েও ঘুরে দেখা যায়,’১৫ প্রকল্পের মধ্যে ৪ টি প্রকল্প দরপত্রের মাধ্যমে করা হয়েছে। এগারোটি প্রকল্প কোটেশনের মাধ্যমে করা হয়েছে। কোটেশনের মাধ্যমে করা প্রকল্পের ব্যাপক নিয়ম দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। মেলান্দহ বাজার থেকে খাশিমারা বাজার রাস্তায় ইউ- ড্রেন নির্মাণ নামে প্রকল্প রয়েছে। তবে সরেজমিনে গিয়ে ওই প্রকল্প নামে কোন রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। যা অস্তিত্বহীন নামে প্রকল্প নেওয়া হয়। উপজেলা অফিসার্স ক্লাবের নামে ৫ লাখ টাকার প্রকল্পে ক্লাবটির বাইরে অংশে কোন কাজ দেখা যাইনি। উপজেলার বিভিন্ন রাস্তায় আরসিসি পাইপ সরবরাহে ১০ লাখ টাকার প্রকল্পের টপঅর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে মেরামত ও রং করণে ৬ লাখ টাকার প্রকল্পে নামমাত্র বাসভবনে রং করা হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় সোলার লাইট স্থাপন প্রকল্পে আংশিক লাইট স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বেশিরভাগ লাইট আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের বাড়িতে স্থাপন করা হয়।

মেলান্দহে এমএ গফুর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক মো.কফিল উদ্দিন বলেন,’আমরা কয়েক বছরের মধ্যে কোন ক্রীড়া সামগ্রী পাইনি। আমরা কখনো চাইতেও যাইনি।’

জাহানারা লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোলাম মোস্তফা বলেন,’উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আমাদের বিদ্যালয়ে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার কোন সামগ্রী বা ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ করে নাই। এবং দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে কোন স্কুল ব্যাগ বিতরণ করনি এ বিদ্যালয়ে।

মেলান্দহ উপজেলা অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বলেন,’ক্লাবের জন্য কত টাকা বরাদ্দ ছিল তা আমার জানা নেই। আর বরাদ্দের টাকা কে তুলেছে তাও জানি না। যারা প্রকল্পের কমিটিতে ছিল তাঁরা ভালো বলতে পারবে। তবে ক্লাবের ভিতরে কিছুটা কাজ হয়েছে।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ও এডিপির প্রকল্প কমিটির সদস্য মো. আতিকুর রহমান বলেন,’আমাদের হাসপাতালে গাড়ী রাখার গ্যারেজ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প ছিল তা সম্পূর্ণ কাজ করা হয়েছে। অফিসার্স ক্লাবের বরাদ্দের টাকার বিষয়ে জানা না। কমিটিতে আমার নাম ছিলো, থাকতে হয়েছে তাই ছিলাম।

স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ‘উপজেলা প্রকৌশলী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি যোগসাজশে এসব প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করেছে। বিভিন্ন নামে প্রকল্প তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে তাঁরা।

উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী (এলজিইডি) শুভাশিষ রায় বলেন,’প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বলতে পারবো। তাছাড়া উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কিছু বলতে পারব না। এছাড়া এসব প্রকল্পের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাইনি উপজেলা প্রকৌশলী।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমি কয়েক মাস আগে এই উপজেলায় এসেছি। এসব প্রকল্পের বিষয়ে আমার কোন কিছু জানা নেই। যেসব অভিযোগ উঠেছে তা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ